কমলা হ্যারিস কেন নয়? | তাবাসসুম মজুমদার অরিন


বাস্তবিক রাজনৈতিক দুনিয়ায় কমলা হ্যারিসের পরাজয়ের সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য কারণ হিসেবে দর্শিত হবে অর্থনীতি, অভিবাসন এবং নিজ দলের প্রতিনিধি হিসেবে ভবিষ্যতে ‘দি গ্রেট আমেরিকা’ তৈরি করার ক্ষমতা সম্পর্কে দৃষ্টান্ত গড়ে তুলতে পারার অক্ষমতা। কিন্তু ২৪৮ বছরের মার্কিন রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিষয় অন্তত বর্তমান সময়ে আর কোনোভাবেই দৃষ্টিগোচর নয়, সেটি হলো মার্কিন, নির্বাচনে জেন্ডার পলিটিক্স। পৃথিবীর তথাকথিত সবচেয়ে উন্নত নেতৃত্বাধীন দেশের ইতিহাসে একজন নারী প্রেসিডেন্টের নাম খুঁজা মরীচিকা বৈ কিছুই না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় লিঙ্গের রাজনৈতিক যাত্রার নমুনা কিছুটা এমন, ১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মতো মারগারেট চেজ স্মিথ রিপাব্লিকান দলের প্রেসিডেন্ট মনোয়নের প্রার্থীপদ খুঁজছিলেন, যখন রাজনৈতিক মহলে ছিল শুধু মাত্রই পুরুষদের দাপট। তিনি প্রাথমিক ব্যলটিং-এ পঞ্চম স্থানে ছিলেন এবং চূড়ান্ত ব্যলট থেকে বাদ পড়েন। মারগারেট চেজ স্মিথ ছিলেন প্রথম নারী যিনি কিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উভয় কক্ষে দায়িত্ব পালন করেন। স্মিথের এই হারকে অনিবার্য ধরে নিলেও ৬০-এর দশকে সাধারন মার্কিন নারীদের জীবনে আসে অভিনব কিছু পরিবর্তন। এই দশকেই আমেরিকায় নারীদের জন্য বৈতনিক চাকরির পদের সংখ্যা বেড়ে যায়। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ন্যাশানাল অর্গানাইজেশন ফর উইমেন’ এবং ৬০-এর দশকের শেষের দিকে নাটকীয় এক পরিবর্তন আসে বেডরুমে—৮০ শতাংশ গর্ভধারণে সক্ষম বিবাহিত নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল নেয়া শুরু করেন, যা সেই সময়ে সমাজে নারীদের নিজ অবস্থানের দৃঢ়তা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।

১৯৬৮ সালে শারলি চিশ্লম নামের একজন আমেরিকান রাজনীতিবীদ সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। শারলি চিশ্লম ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে নির্বাচিত প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী, যিনি পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট মনোয়নের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু অর্থ স্বল্পতা এবং নিরাপত্তা হুমকির জন্য তার প্রচারনার কাজ চালিয়ে যেতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং সবশেষে তিনি পরাজিত হন। মজার বিষয় হচ্ছে শারলি চিশ্লম যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট ডিবেটে অংশগ্রহণকারী প্রথম নারী। ৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকায় সমগ্র নারীবাদীদের মনে আশার আলো জাগায় গেরাল্ডাইন ফেরারো। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রথম নারী টিকিটধারী। তবে ১৯৮৪ সালের সেই নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রোনাল্ড রেগান জয়ী হয়।

প্রত্যেকটি ঘটনাই ছিল পক্ষপাতমূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একেকটি মাইলফলক। যার গতিধারা ধরেই ২০১৬ সালে হিলারী ক্লিন্টন প্রথমবারের মতন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিনিধি হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন এবং পপুলার ভোটেও জয়ী হন। ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনের অনানুষ্ঠানিক পর্বের শুরুতে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেন তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না, ফলস্বরুপ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে মনোনয়নপ্রাপ্ত হন মার্কিন প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।

রিপাব্লিকান পার্টি প্রতিনিধি ট্রাম্প এবং তার অনুসারীরা কমলা হ্যারিসকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়েছেন এই বলে যে—“কমলা হ্যারিস স্পষ্টতই একজন ডিইয়াই এজেন্ট।” এবং সাবেক সান ফ্রাঞ্চিস্কো মেয়র উইলি ব্রাউনের সাথে কমলা হ্যারিসের সংক্ষেপ প্রেমের সম্পর্ক নিয়েও রয়েছে তিরস্কার—ট্রাম্প অনুসারীরা বলছেন কমলা হ্যারিস এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন।

শুধু তাই নয়, ২০২১ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমলা হ্যারিসের প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাব্লিকান পার্টির জে ডি ভেন্স কমলার নিঃসন্তান বিষয়ে কটুক্তি করেছিলেন এই বলে, “আমরা খুব ভালোভাবে আমাদের দেশকে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত করছি, কিছু সংখ্যালঘু কর্পোরেট লোক এবং নিঃসন্তান কেট লেডি দ্বারা।” যদিও জেডি ভেন্সকে পরাজিত করেই হ্যারিস ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারণে কমলা হ্যারিসের উপর ছিল সাধারণ মানুষের যৌক্তিক সব আকাঙ্খা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি ব্যর্থ হয়েছেন সেসব আকাঙ্খার জায়গা ধরে রাখতে গিয়ে।

প্রাথমিকভাবে যাচাই করলে ট্রাম্পের তুলনায় হ্যারিস নারীদের ভোট বেশি পেলেও (প্রায় ৫৪ শতাংশ) ২০২০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী বাইডেনের নারী ভোটারের তুলনায় তা ৩ শতাংশ কম। আবার ২০১৬ সালের নির্বাচনে নারীদের ভোটে এগিয়ে ছিলেন হিলারী ক্লিন্টন। সেবার ক্লিন্টন পেয়েছিলেন ৫৪ শতাংশ নারী সমর্থকদের ভোট এবং ট্রাম্প পেয়েছিলেন ৩৯ শতাংশ। কিন্তু শেতাঙ্গ নারী সমর্থকদের ভোটে এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প, যদিও ব্যবধান ছিল মাত্র ২ শতাংশ।

তাছাড়া রাজনীতির জগতে বাস্তবতা গ্রহণ করে নেয়াই মঙ্গল। হ্যারিস যদিও বা সব ধরনের জেন্ডার এবং রেস বায়াসড কটুক্তি হেসে-খেলে কূটনৈতিকভাবে সামলাচ্ছিলেন, কিন্তু এই নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন এমন একজনের সাথে, যিনি গত ৯ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রয়াস জ্ঞাপন করছেন। তার সাথে ১৬ সপ্তাহের ক্যাম্পেইনে পেরে উঠার জন্য যে ইস্যুতে বেশি সময় ব্যয় করেছেন তা নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণে খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক। যেখানে সুইং স্টেটগুলোর আসল কনসার্ন ছিলো অন্য জায়গায়। আর মনে রাখা ভালো, সাব আরবান শেতাঙ্গ নারীরা এসব এবরশন ইস্যুতে স্পর্শকাতর।

তাহলে কি বলা যেতে পারে যে, হ্যারিস নিজস্ব কটুক্তিগুলো কূটনৈতিকভাবে সামলিয়ে ওমেন কার্ড প্লে না করলেও তিনি এবরশমের মত সেন্সিটিভ একটি ইস্যু নিয়ে নারী ভোটারদের মন জয় করতে চেয়েছেন? রাজনীতিতে শক্তিমত্তা চর্চায় এমন অনেক কিছুই সম্ভব। এখন অনেকেই আবার মুদ্রার ওপিঠের প্রশ্ন করবে হয়ত—কাচের সিলিং-এ অর্থাৎ টপ পজিশনে জেন্ডার পলিটিক্স শিফট হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে উপর মহলের দর কষাকষি জেন্ডার গ্যাপ তৈরি করছে না তো! সহজ আখ্যান হলো, জেন্ডার গ্যাপ ইতিহাসের শুরু থেকেই ছিল, যার ফলস্বরুপ ২৪৮ বছর পরেও একজন নারী প্রেসিডেন্ট দেখার সৌভাগ্য আমেরিকান জনগণদের হয়নি। আর আমেরিকান নির্বাচন যে সত্যিই জেন্ডার বায়াসড এই বিষয় ট্রাম্পের ৩ নির্বাচনের অংশগ্রহণেই টের পাওয়া যায়—যে ২ টি নির্বাচনে তার জয়ের পতাকা উড়েছে, সে-ই দুইটি নির্বাচনেই ছিলো নারী প্রতিপক্ষ—হিলারী ক্লিন্টন এবং কমলা হ্যারিস।

প্রাসঙ্গিক হিসেবে তাই শেষে হিলারী ক্লিন্টনের উক্তি দিয়ে শেষ করা যায়, “The highest and hardest ceiling of the glass yet to break. Progress is possible but not guaranteed. We have to be in a continuous fight for it till the end.
“Let's see what women can do for America, not what America can do for women.”



তাবাসসুম মজুমদার অরিন, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

Post a Comment

0 Comments