নাহ, খবরের কাগজ আর পড়া যাবে না। সকাল নামক সুন্দর বাস্তবতার এভাবে অপচয় করা উচিত না। দিনকালের খবর আর না জানলেও চলবে। এতোদিন জেনেও যেহেতু কোনো লাভ হয়নি, সুতরাং আর জেনে কাজ নেই। এর থেকে ভালো ফেসবুকে নিজের অবস্থান একটু যাচাই করে দেখা। যদিও ফেসবুকে আরও বড় বড় কলামিস্ট সুশীল মানুষ আরও আকর্ষণীয় একটা সমাজ গড়ে তুলেছে। সেই সমাজকে ভার্চুয়াল সমাজ বলা হয়। কী সৌভাগ্য আমাদের আমরা দুই দুইটা সমাজের নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকতে পারছি!
কাগজের ব্যপারটা জানি না, তবে নিজের ব্যপারে আজকাল বেশ সন্দেহ হয় যে, আমি মানুষ কিনা! না মানে মানুষ হওয়ার বিষয়টা যদি কেবল রক্ত মাংসের ব্যপার হয় তবে ঠিক আছে সব। তবে সকল কিছুর মধ্যে থেকেও কিছু বুঝতে না পারার বিষয় মেনে নিতে পারছি না নিজ থেকে। মনে হচ্ছে আমি ঘুমিয়ে আছি। জেগে উঠা উচিত এমন একটা তাড়না নিজের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি তা ঠিক, তবে সেই তাড়নার মধ্যে যে পরিমাণ শক্তি থাকা প্রয়োজন তা যে নেই তাও বুঝতে পারছি। এমন অবস্থায় আমি সাধারণত অন্ধকার রুমে একটা সোফায় একদম একলা বসে থাকি। আমার সবসময় মনে হয় কেউ বোধহয় আছে আমার সাথে। না, তেমন অশরীরী কিছু অনুভব হয় না। কেউ আছে বলতে আমি আসলে নিজের সাথে নিজেরই একটা যে ভালো বোঝাপড়া আছে তার দিকে ইঙ্গিত করছি। নিজেকে নিজে সঙ্গ দেয় যে, সে বোধহয় অন্যের ভালো বন্ধু। ফেসবুকের টাইমলাইনে এসব ভেসে উঠলে আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু, যাদের এসব বাজে আলাপের সঙ্গে জড়ানো হয়, তারা জানে এসব আলাপ কতোটা মিথ্যা।
সোফায় বসে থাকা অবস্থায় আমি দেখি আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বাড়ির লোকজন। তারা কেউ কেউ আমাকে দেখে। নতুন কিছু আর বলার নেই বলে শুধু কিছু একটা বলতে চায় এমন একটা ভাব করে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। একই লোকজনের সাথে ত্রিশ বছর কেটে গেলে এমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক যদিও। আমারও মাঝে মাঝে মনে হয়, এবার অন্য কোথাও অন্য কোনো জায়গায় জীবনের পরবর্তী ত্রিশ বছর কাটিয়ে দিলে ভালো হয়। অলীক কল্পনার মধ্যে আমি অন্ধকারে এভাবেই নিজেকে নিজের অস্তিত্বের কথা জানান দিই।
দূর থেকে নয় মনে হয়, যেন খুব কাছ থেকে ট্রেনের শব্দ ভেসে আসছে। ট্রেনের শব্দের মধ্যে এই জাদু আছে। একটা জড় বস্তুর শব্দ যে এতোটা কাছের মনে হতে পারে, তা এই শব্দের ভেতরে প্রবেশ না করলে জানতে পারতাম না। এমনটা কেন হয়? জানি না। বোধহয় শব্দের মধ্যে আছে পুরনো জায়গা ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ আর নতুন জায়গায় পৌঁছানোর উচ্ছাস। দুই বিপরীতধর্মী আবেগ ট্রেনের শব্দকে করে তোলে আরও বেশী কাছের।
আবেগ একটা বাজে ব্যপার যদিও। এই আবেগ যতো সর্বনাশের মূল। কতো আয়োজন চারদিকে অথচ আমার মন জুড়ে আছে শুধু সেই ভাবনা যার মূল্য নেই। কাকে প্রথম কে কীভাবে জড়িয়ে ধরলো, তার চিন্তাতেই অস্থির আমি। গতকাল না আগের দিন তা জানি না, ভূলে গেছি, খবরের কাগজে দেখলাম সীমার ছবি। সীমা আমার সাথে কলেজে পড়তো। ঝকঝকে পরিষ্কার চেহারার আকর্ষণীয় তরুণী ছিলো সে আমাদের কাছে। আমাদের কতো বন্ধুর দিনরাত অস্থির আবেগে কেটে গিয়েছিল শুধু তার কথা ভেবে ভেবে। আমাদের দৈহিক আনন্দ দেওয়ার জন্য শুধু তার কথা চিন্তা করতাম এ কথা না মেনে লাভ নেই আর।
কিছুদিনের মধ্যে আমরা জানতে পারি কোনো এক রাজনৈতিক বড়ভাইয়ের সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মুষড়ে পড়ি। আমরা না, এবার আমি। খোঁজ নিতে থাকি তার সম্পর্কে। সে জটিল ধাঁধার মতো আমার সামনে উপস্থিত হয় শুধু। আমি তবুও চালিয়ে যেতে থাকি অনুসন্ধান। আশেপাশের বন্ধুরা ঠাট্টা করে আমাকে নিয়ে। গায়ে মাখি না। একসময় আবিষ্কার করি, সীমা আমার এতোটাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে যে, তাকে যে আমি আমার সাথে ক্লাস করতে দেখছি এটাও অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেই সীমাকে দেখলাম রাফিন ইন্ডাস্ট্রির মালিকের ছেলের সাথে খবরের কাগজে। ঝকঝকে চেহারা যেন এখন আরও বেশী রূপের মালিক হয়েছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে নাকি লোক বলবো? আচ্ছা, যাইহোক তাকে দেখে মনে হয় সীমার সাথে মানাচ্ছে না। আবার তার টাকার কথা যখন মাথায় আসে, মনে হয়, সীমাকেই আসলে তার পাশে মানাচ্ছে না। সীমার অগ্রগতি কীভাবে হয়েছে তা আমি জানি। এখনও মাঝে মাঝে আমার কলেজের বন্ধুরা তাকে নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠে। আকারে ইঙ্গিতে কখনও খুব সরাসরি অনেক কিছু বুঝাতে চায়। তবে যে যাই বলুক, আমি সীমাকে প্রশংসাই করি। একটা যুগকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া কম কথা নয়। যুগের হাওয়া খুব কম মানুষ ধারণ করতে পারে। সীমা পেরেছে, তাই তার ব্যপারে মন্দ কথা বলে লাভ নাই। তারাই এখনকার একদম পারফেক্ট নাগরিক।
আমার অতি সচেতন বন্ধু আরিফ এসব ব্যপারকে খুব আত্মীয় আলাপ হিসেবে আলাপ করে। এসব ঘটনায় তার নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যখ্যা হাজির করে। অনেক জানাশোনার মানুষ সে। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। মাঝে মাঝে টকশোতেও যায়। তার মতে এসব ব্যবসায়ীদের মূল বিষয়ের উপর পর্দা দিতে ব্যবহার করা হয়। আমার খটকা লাগে তার আলাপে। পাল্টা প্রশ্ন করি, কীভাবে? সে উত্তর দেয় মূল বিষয় হলো বাজারের অবস্থা খারাপ। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে খুব বেশী। মানুষের জীবনযাপন কষ্টের হয়ে গেছে। তারউপর কর্পোরেট কোম্পানিগুলো গিলে খাচ্ছে সব। আমাকে তোকে চালাচ্ছে নিজেদের মতো করে। আমি আবারও বলি, না মানে, তা ঠিক হয়তো, তবে এর সাথে এসবের কী সম্পর্ক? রেগে যায় একটু, তবে সামলে নেয় সে; বলে, সম্পর্ক আছে মানে! এসব হলো সব এই-এই আসল বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখার জন্য তৈরি ফাঁদ। এখানে সে-ই সেলিব্রিটি জানেও না যে তাকে কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তার ইমেজ কীভাবে ব্যবহার করছে একটা পক্ষ তাও সে ধরতে পারে না। আর এসব করতে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করে মিডিয়া। সেটা মূলধারার মিডিয়া হতে পারে, আবার সোশাল মিডিয়াও হতে পারে। মূল মিডিয়া আজেবাজে খবরকে বেশী ফোকাসে রাখে আর এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সযত্নে এড়িয়ে চলে। এই মূল মিডিয়ার খবরগুলো ফেসবুকের মতো জিনিসগুলোতে প্রভাব বিস্তার করে। কারণ, সেসবে মানুষের কানেক্টিভিটি বেশী। আর সেইসব সেলিব্রিটিরাও এগুলো মনে হয় জানে। তারা নিজেদের প্রোডাক্ট হিসেবে উপস্থাপন করতেই বোধহয় বেশী পছন্দ করে।
আমি মাথা দুলিয়ে বসে থাকি বন্ধুর পাশে। তোদের সংবিৎ ফিরে না কেন? আমি নিরুত্তর থাকি কিছুক্ষণ। আমি উত্তরে বলি, কী লাভ এসবে? আমাদের কী এসে যায়? জীবন তো এমনেই চলে যাচ্ছে। আমরা যাই করি না কেন, আমরা তো কোনোদিন প্রধান চরিত্র হতে পারবো না। এর থেকে ভালো তাদের তাদের মতো থাকতে দেওয়া। দুনিয়াটা বোধহয় তাদের জন্যই তৈরি করা। আমরা অপশনাল সাবজেক্ট আসলে। বন্ধু রেগে যায়; ইতর মিডলক্লাস বলে রাগ ঝাড়ে। আমি চুপচাপ থাকি।
এসবের মাঝখানেও আমি আমার অবস্থান যাচাই করতে নামি। বন্ধুর কথাগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। ভালোই লাগে। এসব আলাপ দেখতে-শুনতে ভালো। তবে বাস্তবতা বলে, লাভ নাই এসবে। আমার কোনোদিনও মনে হয় না, মানুষ খুব করে চায় যে, সে পরিবর্তন হোক। মানুষ এমন সমকালীন অবস্থা উপভোগ করে। সবাই আমার মতো করেই ভাবে। হয়তো ভাবতে বাধ্য হয়। তবে এই যে কথায় কথায় মানুষকে জেগে উঠতে বলা হয়, আমি তার বিরুদ্ধে। এমন আলাপ ভালো লাগে না। মানুষ জেগেই থাকে। এই জেগে থাকা তাকে বন্দি হতে বলে। এর থেকে ভালো হতো, মানুষ যদি ঘুমিয়ে থাকতো। আচ্ছা, তবে কী হতো? এ যেমন পৃথিবীর সকল মানুষ ঘুমিয়ে আছে। তারা শুধুমাত্র স্বপ্নে একে অন্যকে চিনে। স্বপ্নেই তারা জাগতিক সকল কিছু করে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, প্রেম সকল কিছুই সব স্বপ্নেই হয়। মানুষ একটা গোলকধাঁধায় আটকে আছে, যা কিনা স্বপ্ন, এমন হলেই ভালো হতো। তখন ঘুমিয়ে থাকাকে হয়তো বলা যেত জাগ্রত অবস্থা আর জাগ্রত অবস্থাকে বলা যেতো ঘুমিয়ে থাকা। মানুষ বোধহয় তখন ঘুমিয়ে থাকাকেই অপছন্দ করতো। জাগ্রত অবস্থায় থাকতে বেশী পছন্দ করতো। মানুষকে বোধহয় এভাবেই একমাত্র জাগিয়ে তোলা সম্ভব। আরিফরা এভাবে বোধহয় ভাবে না। তারা খুব স্ট্রাকচারাল চিন্তায় অভ্যস্ত। এভাবে হবে না।
তবে আরিফের বেশ কিছু বিষয় আমার ভালো লাগে না। না মানে, ফেসবুকের আলাপে যখন তারে দেখি মনে হয় আরিফের যে ইমেজ আমার সামনে উপস্থিত, তার সাথে এসব যায় না। দুনিয়ার অনেক সমস্যা নিয়ে সে আলাপ করে। পারফেক্ট কালচারাল অ্যাকটিভিটিতে ব্যস্ত মানুষ হিসেবেই আমি তাকে দেখতে চায়। কিন্তু সে মাঝে মাঝে হালকা পোস্ট শেয়ার করে। খেলাধুলা নিয়েও কিছু লেখা লেখে। এগুলো ভালো লাগে না। তাকে বিষয়টা আমি জানাইও।
আরিফ কিছুটা অবাক হয় এমন কথা শুনে। এর উত্তরে কিছু একটা বলতে যেয়ে প্রথমে আটকে যায়। যেন ভাবছে কী বলা উচিত। ইতস্তততা কাটিয়ে বলে, আমি কোনোদিন ভাবি নাই আমারও একটা সাধারণ ইমেজ তৈরী হয়ে গেছে সবার মনে। সবাই ভেবে রেখেছে যে, এ হলো এমন একটা মানুষ, যে এসব নির্দিষ্ট কাজগুলোই করবে৷ এর বাইরে কোনো কাজ করতে পারবে না। এর কোনো মানে নাই আমার কাছে। এসব মানুষকে একটা গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখে। মানুষ আটকে যায় অন্যের চিন্তায়। এর থেকে বের হওয়ার উপায় নাই কোনো। এভাবে পারা যাবে না। তোদের সংবিৎ ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। সে হতাশ হয়ে যায় আমাদের উপর। আবার মিডল ক্লাস ইতর বলে গালি দেয়।
এসব নিয়েই আমার একাকি একটা রাত কাটে। পাশে রীমি মরার মতো ঘুমিয়ে থাকে। ছুঁতেও ইচ্ছে করে না। একে আর একদম ভালো লাগে না। আর কতোদিন থাকা যায়! বিরক্তিকর মনে হয় এই সংসার। রীমির শরীরও মরে গেছে একদম। কোনো অনুভুতি কাজ করে না যেন। থাকার জন্যই থাকা। এতোকিছুর পরেও আমি আশা নিয়ে বসে থাকি যে কিছু একটা জেগে উঠবে আমার মনে। জাগতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আবার যৌবনের উদ্দীপনা যথাযথ মর্যাদায় আমার মনে কাজ করবে। সত্যি কথা হলো এই আরিফদের সংবিৎ ফিরে আসার সম্ভাবনার জন্যই বোধহয় আমাদের বেঁচে থাকা। এই জীবনের আর কোনো মানে আছে বলে আমার মনে হয় না।
সিয়াম আল জাকি,
লোক প্রশাসন বিভাগ;
[email protected]
0 Comments